ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে পদ্মা পেরোলে ফরিদপুরের ভাঙ্গাকে বলা যায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার। ভৌগোলিকভাবেও উপজেলাটি ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার কেন্দ্রবিন্দু। শুধু তাই নয়, নানা কারণে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট হয়ে উঠেছে। আর এই সুযোগে ভাঙ্গা এলাকা ঘিরে গড়ে উঠেছে মাদক কারবারের ‘নতুন হাট’। অবৈধ এই বাণিজ্যে মূল ভূমিকা রাখছেন অন্তত ১৫ ‘ইজারাদার’। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) ও স্থানীয় সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এবং কালবেলার অনুসন্ধানে ভাঙ্গায় মাদকের ‘নতুন হাব’ এবং এর নিয়ন্ত্রকদের নামসহ চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বলছে, ভাঙ্গা এলাকা ঘিরে গড়ে ওঠা মাদকের হাটে কক্সবাজারের টেকনাফ ও চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবার চালান আসছে। রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়াকড়ি থাকায় সেখানে বেশিরভাগ চালান যাচ্ছে ভিন্ন রুটে। এই বাণিজ্যের অর্থ লেনদেন হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। ভাঙ্গায় বসে মোবাইলের বোতাম টিপে কোটি টাকা পাঠানো হচ্ছে টেকনাফে। বিনিময়ে সেখান থেকে আসছে ইয়াবার বড় চালান। এরপর এগুলো ভাগ হয়ে চলে যাচ্ছে ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায়।
টেকনাফে মাদকের বড় পাইকারদের সঙ্গে ভাঙ্গার পাইকারদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা লেনদেনের বেশকিছু তথ্য এসেছে কালবেলার হাতে। সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মাত্র দুই মাসে ১২টি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ভাঙ্গা থেকে টেকনাফে ১ কোটি ৬ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৩ টাকা পাঠানো হয়েছে। ভাঙ্গা থেকে তিন ব্যক্তি তাদের ব্যক্তিগত মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট এবং এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এই টাকা পাঠান। টেকনাফে পাঁচ ব্যক্তি টাকাগুলো গ্রহণ করে।
প্রাপ্ত নথি যাচাই করে দেখা গেছে, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের ননীক্ষীর এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম একই এলাকার দুই এজেন্টকে দিয়ে টেকনাফে মাদক ডিলারদের কাছে এই টাকা পাঠান। তাদের পাঠানো টাকা গ্রহণ করেন মো. ওয়াসিম, মোক্তার হোসেন, রশিদ আহম্মদ ওরফে রশিদ বদ্দা, আবুল কালাম ও ফরিদুল ইসলাম।
তাদের অবস্থান কক্সবাজারের টেকনাফ ও চট্টগ্রামের আশপাশের এলাকায় বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ কালবেলাকে বলেন, ‘ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা ঘিরে একটি মাদক চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। স্বল্প জনবল নিয়েই ওই এলাকায় নজরদারি এবং অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘নতুন কোনো মাদকের হাব গড়ে উঠলে সেটি অবশ্যই ভেঙে দেওয়া হবে। এই চক্রের সঙ্গে জড়িতদের অনেককেই শনাক্ত করা গেছে। আরও যদি কেউ জড়িত থাকে, তাহলে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
ভাঙ্গায় ‘মাদকের হাটের’ ‘ইজারাদার’ যারা:
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, ভাঙ্গাকেন্দ্রিক মাদকের নতুন হাবে মাঠ পর্যায়ে নিয়ন্ত্রক মুকসুদপুরের ননীক্ষীর গ্রামের সাইফুল ইসলাম। তিনি অর্থ লেনদেনে ব্যবহার করেন একই গ্রামের দুজন বিকাশ ও নগদের এজেন্ট এস এম আকিদুল ইসলাম ও নীল রতন বাড়ৈকে।
সাইফুল ইসলামের অর্থ লেনদেনের সূত্র খুঁজতে গিয়ে মাদককারবারিদের আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। সাইফুলের অন্যতম প্রধান অর্থ সরবরাহকারী ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার ভুলবাড়িয়া গ্রামের আবু বক্কার ওরফে রুবেল। ডিএনসির ফরিদপুর কার্যালয় গত বছরের ডিসেম্বরে এই রুবেলের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আইস, কোকেন ও পেনসিলের শিষের মতো কালো ৪৪ টুকরো ব্ল্যাক কোকেন উদ্ধার করে। ফরিদপুর তথা দক্ষিণাঞ্চলের ব্ল্যাক কোকেন উদ্ধারের প্রথম ঘটনা ছিল সেটি। সাইফুল ইসলামের মাধ্যমে টেকনাফে অর্থ পাঠান ফরিদপুরের আরেক মাদককারবারি মো. ইমরান হোসেন মুন্সি ওরফে সাদ্দাম হোসেন। এলাকায় মাদকের ডন নামে পরিচিত ইমরানের বিরুদ্ধে ফরিদপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম মহানগরের বিভিন্ন থানায় অন্তত ১০টি মাদক মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, এই চক্রে আরেক অংশীদার মাসুদ দেওয়ান। মুকসুদপুরের পাইকদিয়া এলাকার নাজমুল ইসলাম ওরফে আকাশ শেখ সাইফুলের অন্যতম প্রধান সহযোগী। এলাকায়ও বেশ প্রভাবশালী তিনি। তার বিরুদ্ধে মুকসুদপুর থানায় ছয়টি ও রাজধানীর বাড্ডা থানায় একটি মামলা রয়েছে। আরেক ইজারাদার শরিফুল ইসলাম টগরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অস্ত্র, মাদকসহ বিভিন্ন ধারায় অন্তত ২৭টি মামলা রয়েছে। অন্য সহযোগী মুকসুদপুরের মাদকসম্রাট রফিকুল ইসলাম ফকির। তাকে ডাকাত সর্দার নামেও চেনে লোকজন। এই রফিকের বিরুদ্ধে গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের বিভিন্ন থানায় অস্ত্র, ডাকাতিসহ ১৫টি মামলা আছে। এ ছাড়া ইজারাদার সিন্ডিকেটের সদস্য গাউছ খন্দকারের বিরুদ্ধে মাদারীপুরের বিভিন্ন থানায় ৯টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া সাইফুলকে মাদকের টাকা পৌঁছে দিয়ে ইয়াবার চালান নেন ভাঙ্গার মাদককারবারি বিদেশফেরত শফিউল মোল্লা স্বপন, ছামাদ মাতুব্বর, সালথার সন্ত্রাসী গাউছ মোল্লা, কানাইপুরের ফিরোজ খান, কাশিয়ানীর পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের এজেন্ট আজাদুর রহমান, বামনডাঙ্গার দুর্ধর্ষ মাদকসম্রাজ্ঞী মিলি বেগম, রাজৈর এলাকার মহসীন মোল্লা। এসব মাদককারবারির আবার এলাকায় রয়েছে আলাদা গ্যাং, যারা খুচরা পর্যায়ে মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবা পৌঁছে দেয়। তাদের সবার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে।
ভাঙ্গা টু টেকনাফ কোটি টাকার লেনদেন:
সাইফুল ইসলাম ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকার মাদককারবারিদের থেকে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ করেন। এই কাজে সাইফুল নিজের দুটি বিকাশ অ্যাকাউন্ট, একটি নগদ অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারের বিকাশ-নগদের এজেন্ট এসএম আকিদুল ইসলাম ও নীল রতন বাড়ৈর অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতেন। বিকাশ-নগদ লেনদেনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে এই অর্থ লেনদেন করতেন সাইফুল। বিকাশ ও নগদের এই মোবাইল ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় তথ্যের অস্বচ্ছতার সুযোগ নিয়ে তিনি এসব মাদকের অর্থ লেনদেন করেন।
সূত্র থেকে জানা যায়, সাইফুল গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে মে মাসের শুরু পর্যন্ত ১ কোটি ৬ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৩ টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন করেন। এর মধ্যে নিজের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ৬৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫৪১ টাকা, স্থানীয় মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট আকিদুল ইসলামের মাধ্যমে ২৯ লাখ ৭৬ হাজার ১৪২ টাকা ও আরেক এজেন্ট নীল রতনের মাধ্যমে ৮ লাখ ১৩ হাজার ২০০ টাকা লেনদেন করেন। এই লেনদেনের চার মাস সময়ের মধ্যে এক মাসের মতো ফরিদপুর কারাগারে ছিলেন সাইফুল। অর্থাৎ জেলের বাইরে থাকার সময় তিন মাসেই কোটি টাকা লেনদেন করেন তিনি। এই টাকা চট্টগ্রামের মো. ওয়াসিম ও মোক্তার হোসেন এবং টেকনাফের রশিদ বদ্দা, আবুল কালাম ও ফরিদুলের কাছে পৌঁছায়। টাকা পাওয়ার পর তারা সেখান থেকে সাইফুলের কাছে ইয়াবা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
ভাঙ্গার মাদকসম্রাট কে এই সাইফুল:
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভাঙ্গা ঘিরে এই নতুন মাদকচক্রের মাঠ পর্যায়ের মূলহোতা সাইফুলের বাড়ি গোপালগঞ্জ হলেও এক সময় তিনি চট্টগ্রামে বসবাস করতেন। শুরুতে কুমিল্লা থেকে গাঁজা নিয়ে কারবার করতেন ফরিদপুরে। সেই থেকে ওই অঞ্চলসহ আশপাশের তিন থেকে চারটি জেলার চিহ্নিত মাদককারবারিদের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে কারাগারে গিয়ে ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। তাদের মাধ্যমে কক্সবাজারের টেকনাফের কারবারিদের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন চক্র। শুরু হয় তার মাদকের কোটি টাকার কারবার।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাঁজা নিয়ে ফরিদপুর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদস্যদের হাতে গ্রেপ্তার হন সাইফুল। এরপর তাকে ফরিদপুর কারাগারে পাঠানো হয়। ওই সময়ই ফরিদপুরে ইয়াবা সরবরাহ করতে এসে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন মো. ওয়াসিম। কারাগারে এই দুজনের পরিচয় হয়। ওই বছর ১০ মার্চ সাইফুল জামিনে বের হন। এর কয়েকদিন পর ওয়াসিমও জামিনে বের হয়ে যান। এরপর সাইফুল ও ওয়াসিম টেকনাফ টু ভাঙ্গ রুটে ইয়াবা কারাবার শুরু করেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (দক্ষিণ) সহকারী পরিচালক সুব্রত সরকার শুভ কালবেলাকে বলেন, গত বছর মার্চে চট্টগ্রাম থেকে কুরিয়ারে আসা ৫০ হাজার ইয়াবা ফরিদপুরে নিয়ে যাওয়ার সময় রাজধানীর মতিঝিল থেকে ডিএনসির ফরিদপুর জেলা টিম সাইফুলকে গ্রেপ্তার করে। ইয়াবার এই বড় চালানের উৎস খুঁজতে গিয়ে ভাঙ্গাকেন্দ্রিক সাইফুলের ইয়াবা চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়।
ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মাদকচক্রের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ফরিদপুর জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম কালবেলাকে বলেন, ‘ভাঙ্গা উপজেলা থেকে মাদক অন্য এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বা সেখানে মাদকের আলাদা চক্র সম্পর্কে কিছু জানা নেই। এ বিষয়ে তথ্য পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পুলিশ সুপার বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান সব সময়ই জিরো টলারেন্স। আমরা প্রতিনিয়ত মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি। এ বিষয়ে আমরা সতর্ক।’