এ কে এম শহীদুল হক সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি)। তিনি ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার মাধ্যমে ১৯৮৬ সালে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও পুলিশের ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বাংলাদেশে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের অন্যতম প্রবর্তক হিসেবে তিনি কমিউনিটি পুলিশিং ধারণাকে জনগণের প্রতি জনপ্রিয় করে তোলেন। ২০১২ সালে আমেরিকার নিউজার্সি রাজ্যের মেয়র তাকে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা প্রদান করেন। কর্মজীবনে অসামান্য অবদান ও কৃতিত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতির জন্য তিনি বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) এবং রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম)-এ ভূষিত হয়েছেন। তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন—কম্বোডিয়া, অ্যাঙ্গোলা এবং সুদানে দায়িত্ব পালন করে জাতিসংঘের শান্তি পদকেও ভূষিত হন। আইজিপি পদে পদোন্নতি লাভের আগে তিনি সচিব পদমর্যাদায় বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন ও অপারেশন) হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। রাজনৈতিক সহিংসতায় পুলিশ নিহত ও আহত হওয়া, সংশ্লিষ্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণসহ নানা বিষয়ে তিনি দনর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা।
এ কে এম শহীদুল হক : বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবসময়ই একটি সাংঘর্ষিক ভাবধারা বজায় থেকেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো বোঝাপড়া নেই। তারা সহিংসতার পথ গ্রহণ করে তাদের ক্ষমতা দেখাতে চায়। তবে এ বছর আমরা দেখেছি—বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য বড় দলের সমাবেশ একই দিনে পাশাপাশি জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তা শান্তিপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। কোনো ধরনের সংঘাত বা বিবাদ আমরা এসব সমাবেশে দেখিনি। একে ভালো লক্ষণ হিসেবে আমরা দেখছিলাম। কিন্তু ২৮ অক্টোবর যেটা ঘটল সেটাকে আমি কোনো রাজনীতি না বলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলব। বিএনপির কিছু কর্মী যেভাবে সহিংসতা তৈরি করেছে, পুলিশ সদস্যদের যেভাবে পেটানো হয়েছে, তা অমানবিক। একজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। অনেকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন। পুলিশ সদস্যরা সেখানে গিয়েছেন দায়িত্ব পালন করতে। তাদের যেভাবে পেটানো ও একজনকে হত্যা করা হলো, তা মনুষ্যত্বের মধ্যে পড়ে না। কোনো রাজনৈতিক নেতাকর্মী এ ধরনের কাজ করতে পারে না। ইউনিফর্ম পরা একজন মানুষকে এভাবে পিটিয়ে মারতে সন্ত্রাসীদেরও বুক কাঁপে। কিন্তু সেটাই তারা করেছে।
২০১২, ’১৪, ’১৫ সালের দিকেও আমরা দেখেছি তারা কীভাবে সহিংসতা চালিয়েছে এবং মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। সে সময়ও তারা ১৬ জন পুলিশকে টার্গেট করে হত্যা করেছে। সেই ১৬ জন পুলিশ হত্যার একটি মামলায়ও এখন পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি। একে আমি পুলিশের কর্মকর্তাদের অবহেলার কথা বলব। পুলিশ হত্যার এসব মামলা আদালতে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, যেগুলো তারা করেননি। ফলে সন্ত্রাসীরা দেখছে পুলিশ মারলে কিছু হয় না। আর এ কারণেই তারা বেশি সাহস পেয়েছে।
২৮ অক্টোবর তারা রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালে হামলা করে অ্যাম্বুলেন্সে আগুন দিয়েছে। অথচ যুদ্ধক্ষেত্রেও হাসপাতালগুলোকে নিরাপদ রাখা হয়। ফলে এগুলো কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয় বরং এগুলোকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলাই যুক্তিযুক্ত। ৪১ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এসব করে যারা রাজনীতি করেন, তাদের মধ্যে কতটুকু দেশপ্রেম আছে আমি জানি না। যারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় যায় তারাই পুলিশকে ব্যবহার করে। বিএনপি যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল, তারা কি পুলিশকে ব্যবহার করেনি? একুশে আগস্টের ঘটনায় আইজি, একজন ডিআইজি, দুজন এসপি এবং একজন এএসপির সাজা হয়নি? ফলে বিএনপি যেভাবে পুলিশকে ব্যবহার করেছিল, এখন আর সেভাবে পুলিশকে ব্যবহার করা হচ্ছে না। দুটি দলে সংঘর্ষ বাধলে তাদের নিবৃত্ত করাই পুলিশের দায়িত্ব। পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। তাই বলে পুলিশকে প্রতিপক্ষ ভেবে পুলিশের ওপর হামলা করা হবে? এটি কোনো অবস্থায়ই কাম্য নয়। পুলিশকে পিটিয়ে মেরে ফেলা কোনো রাজনীতি হতে পারে না। এটা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ও দুঃখজনক। যে দলের রাজনৈতিক কর্মীরা এরকম একটি কাজ করল, সেই দলের নেতারা একবার দুঃখ প্রকাশও করলেন না। তারা একটি শোকবার্তাও দেননি। আমাদের দেশে যেসব মানবাধিকার সংস্থা বা আন্তর্জাতিক যেসব মানবাধিকার সংস্থা রয়েছে, তারাও কোনো বিবৃতি দেয়নি। তারা একটি শোক প্রস্তাব বা নিন্দা পর্যন্ত জানায়নি। তাহলে মানবাধিকার কাকে বলে?
২৮ অক্টোবর যে সহিংসতা ঘটানো হয়েছে, সেগুলো কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয় বরং এগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আর এগুলো যারা ঘটিয়েছে, সেই দলের নেতাকর্মীদের এর দায় থেকে বাঁচার কোনো সুযোগ নেই।
এ কে এম শহীদুল হক : কাছাকাছি জায়গায় পরস্পরবিরোধী একাধিক রাজনৈতিক দল এবং জোটের সমাবেশ ছিল। ফলে সেখানে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ কারও পক্ষে বা বিপক্ষে মোতায়েন করা হয়নি। যখন দুটি দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল তখন পুলিশ তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছে। পুলিশ তার আইনগত অবস্থানে ছিল। পুলিশ তার ভূমিকা পালন করেছে। চেষ্টা করেছে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করা যায় কি না। পুলিশ এক ধরনের ডিফেন্সিভ অবস্থানে ছিল। সামনে নির্বাচন রেখে রাজনৈতিক প্রোগ্রামে পুলিশের এ ধরনেরই ভূমিকা থাকবে। পুলিশ ধৈর্যের পরিচয় দিতে গিয়ে যখন দেখল তাদের গায়ে হাত পড়েছে, তখন তারা রিঅ্যাক্ট করেছে।
: আগে রাজনৈতিক সহিংসতায় যেসব পুলিশ সদস্য মারা গেছেন তাদের হত্যার বিচার হয়নি কেন?
এ কে এম শহীদুল হক : পুলিশের একটি মনিটরিং সেল রয়েছে। আমি যখন পুলিশের আইজি ছিলাম, তখন এই মনিটরিং সেলের দুটি মিটিং করেছি। সেই মিটিংগুলোতে আমি পুলিশকে নির্দেশনা দিয়েছিলাম, সাক্ষী-প্রমাণ সংগ্রহ করে তদন্তকাজ শেষ করার জন্য। এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পুলিশ চার্জশিট দিয়েছে কি না, সেটা আমার এখন জানা নেই। চার্জশিট দিলে মামলার ট্রায়াল চলত, সেটিও হয়নি। আমার পরে যারা পুলিশের আইজি ছিলেন, তারা এ ব্যাপারে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেননি। প্রতি মাসে একবার করে মনিটরিং সেলের মিটিং হওয়ার কথা। সেখানে এ মামলাগুলো নিয়ে কথা হয় না। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি রয়েছে।
এ কে এম শহীদুল হক : পুলিশ যখন কোনো প্রতিবাদ, মিছিল বা ক্রাউড কন্ট্রোল করতে যাবে, তখন তারা দলবদ্ধভাবে একসঙ্গে থাকবে। যদি কোনো পুলিশ সদস্য দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তখন তার ওপর আক্রমণ হতে পারে। এ ছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার কোনো রিপোর্ট থাকতে পারে যে, পুলিশ আক্রমণের শিকার হতে পারে। এ কারণে তাদের একা চলাফেরা না করার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে।
?
এ কে এম শহীদুল হক : আমি মনে করি পুলিশকে আরও সতর্ক থাকতে হবে এবং পেশাদারিত্ব নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। একজন পুলিশ সদস্য যখন কোনো রাজনৈতিক সহিংসতা কন্ট্রোলে যাবেন, তখন সম্পূর্ণ রায়ট গিয়ার পরিহিত অবস্থায় যেতে হবে। তার পরিহিত হেলমেট থাকতে হবে এবং বুলেটপ্রুফ ভেস্ট থাকতে হবে। যাদের হাতে শিল্ড নেওয়ার কথা তাদের শিল্ড নিতে হবে। পুলিশ সদস্যদের একসঙ্গে দলবদ্ধভাবে থাকতে হবে। এসব কিছুই পুলিশকে তাদের ট্রেনিংয়ের সময় শেখানো হয়। তারা যদি তাদের প্রশিক্ষণ অনুসরণ করেন এবং নিজেরা সচেতন থাকেন, তাহলে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম থাকে। ২৮ অক্টোবর যে পুলিশ সদস্যরা মার খেয়েছেন, তারা মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের একা পেয়ে আক্রমণ করা হয়েছে। পুলিশ যদি তার পেশাদারিত্ব এবং সচেতন থাকে, তাহলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়।